কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
কোরবানির ফজিলত সর্ম্পকে আমাদের সকলেরই জানা প্রয়োজন।আজকে আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করবো কোরবানির ফজিলত নিয়ে।কাদের উপর কোরবানী ওয়াজিব এবং কোরবানীর জন্তুর বয়স কত হতে হবে।
এই বিষয় গুলো নিয়ে কোরবানির ফজিলত সর্ম্পকে বিস্তারিত জানতে এই পোষ্টটি মনোযোগ দিয়ে পরেন তাহলে কোরবানি সর্ম্পকে সঠিক ধারনা পাবেন।
পোস্টসূচীপত্র:কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
কোরবানীর ফজীলত
- কোরবানীর জন্তুর শরীরে যতগুলো পশম রয়েছে, তার প্রত্যেকটি লোমের বদলে এক একটি করে নেকী পাওয়া যায়।
- কোরবানীর দিনে সবচেয়ে বড় ইবাদত হচ্ছে কোরবানী করা।
কাদের উপর কোরবানী ওয়াজিব
- ১০ই যিলহজ্জ এর ফজর হতে ১২ই যিলহজ্জ এর সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্থাৎ, কুরবানীর দিনগুলোতে যার নিকট সদকায়ে ফিতর/ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার পরিমাণ অর্থ সম্পদ বর্তমান থাকবে তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব।
- মুসাফিরের অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি সফরের হালতে থাকলে তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব হয় না।
- কোরবানী ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও যদি কোন ব্যক্তি নফল কুরবানী করে তাহলে সেই ব্যক্তি কোরবানীর সাওয়াব পাবে।
- কোরবানী শুধু নিজের জন্য ওয়াজিব হয়-সন্তান, মাতা পিতা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হয় না। তবে কেউ যদি তাদের পক্ষ থেকে কোরবানী দেয় তাহলে তা নফল কুরবানী হবে।
- যে সকল ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়, তাদের মধ্য হতে কেউ কোরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করলে সে ক্ষেত্রে পশু কোরবানী করা সেই ব্যক্তির উপর ওয়াজিব হয়ে যায়।
- কোন কিছু পাওয়ার অর্থাৎ, মকসুদের জন্য কোরবানীর মানত করলে সেই মকসুদ পূর্ণ হলে সেই ব্যক্তি ধনী হোক বা গরীব, কোরবানী তার উপর ওয়াজিব হবে।
- যদি কোন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব থাকা সত্ত্বেও কোরবানী না করে, তাহলে কোরবানির দিনগুলো চলে যাওয়ার পর একটি বকরীর সম মূল্য সদকা করা ঐ ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব।
কোন কোন জন্তূ দ্বারা কোরবানী করা দুরস্ত
ভেড়া,দুম্বা.ষাড়,মহিষ,বকরী,বলদ,খাসী,পাঠা,ভেরী,গাভী,উট এই কয়েক প্রকার গৃহপালিত জন্তুর দ্বারা কুরবানী করা দূরস্ত আছে।
কোরবানীর জন্তুর বয়স
- খাসী,ভেড়া,বকরী,ভেড়ী,দুম্বা কমপক্ষে পূর্ণ এক বছর বয়সের হতে হবে।কিন্তু যদি কোন ভেড়া, ভেড়ী ও দুম্বার বয়স কিছুটা কম হয় তবে স্বাস্থ্যবান এবং মোটা তাজা হয়, যার ফলে এক বছর বয়সীদের মধ্যে ছেড়ে দিলে যদি তাদেরকে চেনা না যায়, তাহলে তার দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত আছে।তবে অন্তত ছয় মাস বয়স হতে হবে।বকরীর ক্ষেত্রে এরুপ ব্যতিক্রম নেই।বকরী কোন অবস্থাতেই এক বছরের কম বয়সে হতে পারবেনা।
- গরু ও মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে।
- উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে।
কুরবানীর জন্তুর স্বাস্থ্যগত অবস্থা প্রসঙ্গে
- কোরবানীর পশু স্বাস্থ্যবান এবং হৃষ্ট পুষ্ট হওয়া উত্তম।
- যে প্রাণীর পা নেই লেংড়া অর্থাৎ, যে প্রাণী তিন পায়ে চলতে পারে-এক পা মাটিতে রাখতে পারেনা অথবা পা রাখতে পারলেও তার উপর ভর দিয়ে হাঁটতে পারে না, এরুপ পশু দ্বারা কোরবানী জায়েয নয়।
- যে পশুর একটি ও দাঁত নেই সে পশু দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত নয়্। কিন্তু যদি কোন পশু দাঁত না থাকা সত্ত্বেও ঘাস খেতে সক্ষম হয়,তাহলে সে পশু দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
- যে পশুর জন্মের পর থেকেই কান নেই,তা দ্বারা কোরবানি করা দুরস্ত নয়। তবে কান ছোট হলে অসুবিধা নেই।
- যেই পশুর শিং মূল থেকে ভেঙে গেছে তা দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত নয়। তবে শিং একেবারে উঠেইনি বা সিংয়ের আগায় অল্প পরিমাণ ভেঙে গেছে, সেক্ষেত্রে কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
- যেই পশু চোখে দেখেনা অর্থাৎ দুটি চোখ অন্ধ, অথবা একটি চোখ সম্পূর্ণ অন্ধ নতুবা একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি এক তৃতীয়াংশের বেশি নষ্ট, তা দ্বারা কুরবানী করা দুরস্ত নয়।
- যে পশুর একটি কান বা লেজের এক - তৃতীয়াংশের বেশি কেটে গিয়েছে সেই পশু দ্বারা কুরবানী করা দূরস্ত নয়।
- যে সকল পশু দুর্বল এবং কোরবানীর মাঠ পর্যন্ত জবেহের জন্য হেঁটে যাওয়ার শক্তি না থাকে,তাহলে সেই পশু কোরবানী করা দুরস্ত নয়।
- কোরবানীর জন্য ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি এমন কোন দোষ বা ত্রুটি দেখা দেয় যার কারণে কোরবানী দূরস্ত হয় না-এরূপ হলে ঐ পশুটি বাদ দিয়ে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কোরবানী দিতে হবে। কিন্তু ক্রেতা যদি গরীব হয় সে ক্ষেত্রে সেটাই কোরবানী দিতে পারবে।
- গর্ভবতী পশু কোরবানী করা জায়েয। যদি পেটের বাচ্চা জীবিত থাকে তবে সে বাচ্চাও যবেহ করে দিবে। কিন্তু গর্ভবতী পশুটি প্রসবের নিকটবর্তী হলে সেরুপ গর্ভবতী পশু কোরবানী করা মাকরুহ্।
- বন্ধা পশু কুরবানী করা জায়েয।
একটি পশুতে কতজন শরীক হতে পারে?
- খাসী,বকরী,পাঠা,ভেড়ী,ভেড়া ও দুম্বায় একজনের বেশি শরীক হয়ে কুরবানী করা যায় না।এ সকল পশু শুধুমাত্র একজনের নামেই কোরবানী হতে পারে।
- একটি গরু,মহিষ এবং উটে সর্বোচ্চ সাতজন শরীক হতে পারে।তবে সাতজন হওয়া জরুরি নয়, দুইজন,তিনজন,চারজন,পাঁচজন অথবা ছয় জন কোরবানী দিতে পারে।তবে কারোর অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হতে পারবে না।
- মৃত ব্যক্তির নামেও কুরবানী হতে পারে।
- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম,তার বিবিগণ ও বুযুর্গদের নামেও কুরবানী হতে পারে।
- যে ব্যক্তি খাঁটি অন্তরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানী করে না বরং গোশত খাওয়ার বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোরবানি করে,ঐ ব্যক্তিকে অংশীদার বানিয়ে কোন পশু কোরবানী করলে সেই সকল অংশীদারের কোরবানী-ই নষ্ট হয়ে যায়।তাই শরীক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়।
- কোরবানীর পশু ক্রয় করার সময় ক্রেতার শরীক রাখার এরাদা না থাকলেও পরবর্তীতে যদি শরীক গ্রহণ করতে চায় তাহলে ক্রেতা গরিব হলে তা পারবে না,অন্যথায় পারবে।
- যে ব্যাক্তির উপার্জনের বেশিরভাগ অর্থয় হারাম,ওই ব্যক্তিকে যদি শরীকের অংশীদার করা হয় তাহলে অন্যান্য শরীকদের কোরবানি অশুদ্ধ হয়ে যায়।
কুরবানীর পশু জবেহ করার নিয়ম
- নিজের কোরবানীর পশু নিজেই জবেহ করা উত্তম।নিজে জবেহ না করলে বা করতে না পারলে জবেহের সময় সামনে থাকা ভালো।মেয়েলোকেরা যদি তাদের পর্দার কারণে সামনে আসতে সমস্যা হয় তাহলে কোন ক্ষতি নেই।
- কোরবানীর পশুকে মাটিতে শুইয়ে তার মুখ কেবলামুখী করে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করা উত্তম।
কোরবানীর পশু জবেহ করার দোয়া-
উচ্চারণ-ইন্নি ওয়াঝঝাহাতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকীন।ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।লা শারিকা লাহু ওয়া বি-জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন।আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।
আরো পড়ুন : যাকাত দেওয়ার নিয়ম এবং যাকাতের মাসায়েল যেনে নিন
সর্বশেষ,‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’বলে জবেহ করবে।কেউ যদি দোআ পড়তে না
পারে তাহলে শুধু‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলেও জবেহ করতে পারবে।
অতঃপর নিম্নে এই দোআ করা উত্তম-
“আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু মিন্নি কামা তাকাব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিউ
ওয়া খালিইলীকা ইবরাহীমা আলাইহিমাস সালাতু ওয়াসসালাম”
- জবেহকারী যদি উক্ত পশুর কুরবানীদাতা না হয় তাহলে ‘মিন্নি’ এর বদলে ‘মিনহু’ পড়বে।আর কোরবানীদাতা একাধিক হলে‘মিন্নাই’ এর জায়গায় ‘মিন্না’ বা ‘মিনহু’ এর স্থলে ‘মিনহুম’ হবে।
- কুরবানী দাতা বা কোরবানী দাতাগণের নাম মুখে উচ্চারণ করে বা কাগজে লিখে পড়া জরুরী নয়। কারণ আল্লাহ পাক জানেন এটা কার কোরবানী।সে অনুযায়ীই সেই কুরবানী গৃহীত হবে।
- কোরবানীর পশু রাতের বেলায় জবেহ করা যায় তবে তা ভালো নয়।
- ঈদের নামাজ পড়ার পূর্বে কুরবানী করা জায়েয নয়।তবে যেখানে জুমুআ ও ঈদের নামাজ দুরস্ত নয় সেখানে সুবহে সাদেকের পর থেকেই কুরবানী করা দুরস্ত আছে।
কুরবানীর গোশত বন্টনের তরীকা
- কোরবানীতে অংশীদারগণ সকলেই একান্নভুক্ত হলে গোশত বন্টনের প্রয়োজন নেই।অন্যথায় কোরবানীর গোশত বন্টন করতে হবে।
- অংশীদারগণ গোশত অনুমান করে বন্টন করবে না অবশ্যই তা বাটখাড়া দিয়ে ওজন করে বন্টন করতে হবে।অন্যথায় ভাগের গোশত কমবেশ হয়ে গেলে গুনাহগার হতে হবে।অবশ্য কোন অংশীদার যদি মাথা, পায়া ইত্যাদি বিশেষ কোনো অংশ গ্রহণ করে তাহলে তার ভাগে গোশত কিছু কম হলেও তা দুরস্ত হবে।কিন্তু যে ভাগে গোশত বেশি সেই ভাগে মাথা পায়া ইত্যাদি বিশেষ অংশ দেয়া যাবে না।
- অংশীদারগণ সকলে যদি সম্পূর্ণ গোশত দান করে দিতে চায় বা সম্পূর্ণটা রান্না করে বিলাতে বা খাওয়াতে চায় তাহলে বন্টনের প্রয়োজন নেই।
কোরবানীর গোশত খাওয়া ও দান করার মাসায়েল
- কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়া,পরিবার বর্গকে খাওয়ানো,আত্মীয়-স্বজনকে দেয়া এবং গরিব-মিসকীনকে দেয়া সবই জায়েয।মুস্তাহাব ও উত্তম তরীকা হল গোশত ৩ ভাগ করে একভাগ নিজেদের জন্য রাখা, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেয়া এবং একভাগ গরিব-মিসকীনকে দান করা।
- মানতের কোরবানীর গোশত হলে নিজে খেতে পারবে না এবং মালদারকেও দিতে পারবে না,বরং পুরোটাই গরিব-মিসকীনদেরকে দান করে দেয়া ওয়াজিব।
- যদি কোন মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে কোরবানীর জন্য ওছিয়াত করে গিয়ে থাকে তবে সেই কুরবানীর গোশতও মানতের কুরবানীর গোশতের ন্যায় পুরোটাই খয়রাত করা ওয়াজিব।
- কোরবানীর গোশত বা বিশেষ কোনো অংশ যেমন-মাথা,পারিশ্রমিক রূপে জায়েয নয়।
- কোরবানীর গোশত শুকিয়ে বা ফ্রিজে রেখে দীর্ঘদিন খাওয়াতে কোন অসুবিধা নেই।
কোরবানীর পশুর চামড়া সম্পর্কিত মাসায়েল
- কোরবানীর পশুর চামড়া শুকিয়ে বা প্রক্রিয়াজাত করে নিজেও ব্যবহার করা জায়েয।
- কোরবানীর চামড়া খয়রাতও করা যায় তবে বিক্রি করলে সে টাকা নিজে ব্যবহার করা যায় না।খয়রাতই করা জরুরী এবং ঠিক এই টাকাটাই খয়রাত করতে হবে।চামড়া বিক্রির টাকাটা নিজে খরচ করে অন্য টাকা দান করলে আদায় হবে, তবে তা অন্যায় হবে।
- কোরবানীর চামড়ার দাম মসজিদ মাদ্রাসার নির্মাণ কাজে বা বেতন বাবত বা পারিশ্রমিক বাবত বা অন্য কোন নেক কাজে খরচ করা দুরস্ত নয়।সেই টাকা খয়রাতই করতে হবে।
লেখক এর মতামত
কোরবানির ফজিলত নিয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।কোরবানির ফজিলত নিয়ে যদি আপনাদে কোন প্রশ্ন থাকে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।কোরবানির ফজিলত সর্ম্পকে আরো জানতে আলেম দেরকে প্রশ্ন করতে পারেন।
নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url